সমরেশ বসুর “প্রজাপতি” ও কিছু কথা।



গত বইমেলায় সময় দিতে না পারার ও মন মত বই কিনতে না পারার দুঃখ ঘোচাতে এবারের বইমেলা (২০১১) থেকে বেশ কিছু বই কিনেছিলাম। ফেরার পথে পা টেনে টেনে চলতে হচ্ছিল, তবু আনন্দে বুক ভরে যাচ্ছিল আমার। সেই গত দুমাস আগে কেনা বইগুলো পড়ার ফুসরত মিলছিল না। হঠাৎই হাতে যা সময় পাচ্ছি, তাই নিয়ে ঝুলে পরেছি বইগুলো পড়ব বলে। শুরু করেছিলাম তসলিমা নাসরিনের আত্মজীবনীনেই, কিছু নেইদিয়ে, কিন্তু তার পাশাপাশি হাতে তুলে নিলাম আরও একটি বই; নাম তারপ্রজাপতি”, লেখক সমরেশ বসু। প্রচ্ছদে আঁকা একটি পেরেকবিদ্ধ প্রজাপতি! বুঝলাম, রোমান্টিক বা সুখপাঠ্য কোন উপন্যাস নয় এটা। বলতে দ্বিধা নেই, কলকাতার দুচার জন লেখকের লেখার প্রতি আমার এক ধরণের ভাল লাগা কাজ করে। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় তাঁদের অগ্রভাগে। তবে সমরেশ বসুর আর কোন লেখাটি বিগত সময়ে পড়েছি, ঠিক মনে করতে পারছিলাম না; এখনও পারছি না। তবে এটা পড়ে কি এক বোধ যেন কাজ করছে, কি যে বোধ বুঝতে পারছি না। অনেকটা এ উপন্যাসের নায়ক চরিত্র সুখেন্দু যেমন নায়িকা শিখার মধ্যে কি যেন কি আছে টাইপ কিছু একটা খুঁজে ফেরে তার মত! সুখেন; সরকারি আমলা পিতার বখে যাওয়া কনিষ্ঠতম সন্তান। বড় দুই দাদার মত কলেজ জীবনেই রাজনীতির স্বার্থবাদী পাঠ শিখে কর্মজীবনে চাকরি-ব্যবসার পাশাপাশি বাঘা বাঘা দুই পার্টির হর্তা-কর্তা হয়ে এলাকা ভাগাভাগি করে গরিবের নাকের ডগায় মূলো ঝুলিয়ে তথাকথিত জনদরদী নেতা হয়ে উঠতে পারেনি। কলেজ টু আউট অফ কলেজ জীবনে চারপাশের মানুষের কারণে হয়ে উঠেছেসুখেন গুন্ডা’! দেখা হলে সকলে ভাল-মন্দ জিজ্ঞেস করে, পাড়ার বৌদিদের কাছে-পিঠে তার ডাক পড়ে, সরকারি বাবু থেকে পেটমোটা কারবারি; এমনকি দারোগা বাবু পর্যন্ত তাঁকে সমীহ করে চলে। এ কোন ভালবাসা নয়; ভয়। কারণ সবার ঘরের খবর, ঘট আর ঘটির খবর সবটাই যে তাঁর জানা! কাহিনীর শুরু একটা প্রজাপতিকে ধরা নিয়ে সুখেনের একরোখা চেষ্টা আর শিখার তা রুখে দেয়ার প্রাণপন চেষ্টা থেকে। মাঝে সুখেনের পরিবার, শিখার পরিবার, কলেজ জীবনের দাঙ্গাবাজী-হাঙ্গার স্ট্রাইকের স্মৃতিকথা, তাঁদের পাড়ার কিছু ভদ্রবেশী মানুষের সুকীর্তির(!) কথা, সুখেনের নারীজনিত নানা অভিজ্ঞতা, দাদাদের নোংরামী-দলাদলি ইত্যাদি ইত্যাদির পাশাপাশি শিখার প্রতি অজানা-অনাবিষ্কৃত আকর্ষণ বোধ (সুখেনের ভাষায় যাওর মধ্যে কি যেন একটা আছে”) গুন্ডামী জীবনের অন্যতম চ্যালা শিবের বোন মঞ্জরীর সাথে সুখেনের দেহজ সম্পর্ক আছে। এমনকি এ ধরনের মুহূর্তকালের বহু সম্পর্ক গড়েছে-ভেঙ্গেছে তাঁর জীবনে ভদ্দরলোক বলে খ্যাত বহু বাবুদের স্ত্রী, মেয়েদের সঙ্গে। কিন্তু কোনটিই যেন শিখার প্রতি যে নেশা তার মত নয়। শিখার নাড়ী-নক্ষত্র জানা থাকলেও, প্রতিনিয়ত কি যেন একটা অজানা কিছু খুঁজে পেতে চায় সুখেন। এই শিখার জন্যেই একসময় সাধারণ ছেলেটি হবার আকাঙ্খা পেয়ে বসে তাঁকে। স্কুল জীবনের নিরীহ শিক্ষক নিরাপদবাবুর মত নির্বিঘ্ন জীবনে ফিরে যেতে চায়। চোপড়া সাহেবের কাছে চাকরির কথা বলায় নিজেই অবাক হয়! কিন্তু সমাজ, সংসার, মানুষ তাঁকে তা হতে দিল কই? দাদাদের দলাদলি আর শত্রুপক্ষের নির্মম বলী হয় সুখেন। হরতাল চলাকালীন সময়ে পক্ষ আর বিপক্ষদলের যুগপৎ ছুটে আসা মিছিলের মুখে পরে এক দোকানে আশ্রয় নেয়া অবস্থায় দাঙ্গার মাঝে উড়ে আসা এক সর্বনেশে বোমার আঘাতে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় সুখেনের সাধারণ কেউ হবার স্বপ্ন। হারাতে হয় চোখের আলো, পা আর হাত। এ উপন্যাসের কোন চরিত্রই অলৌকিক বা অতিলৌকিক নয়; সবাই বাস্তব জীবনের প্রতিনিধিত্ব করেছে। সুখেন যেন রাস্তার সেই চিরচেনা গুন্ডা ছেলেটি; মুখে যার অশ্রাব্য খিস্তি-খেউর, চোখে রঙ্গিন মদের নেশা আর মনে আপাত অশ্লীল সব ভাবনার বাসা! তবু সেই গুন্ডা হয়েও যেনএই গুন্ডানয় সুখেন, এই নয়টুকুরহয়না হওয়াটাই আমাদেরকে ভাবায়। শেষ পরিণতি ভেতরটা দুদ্দাড় করে কাঁপিয়ে দেয়। ঘৃণা কিংবা করুণা হয় না সুখেনদের প্রতি; হয় সমাজ আর তথাকথিত সমাজপতিদের প্রতি। একসময় বইটা নিষিদ্ধ করা হয়েছিল ভারতে। অশ্লীলতার দায়ে আদালতে চলেছিল মামলা। অভিযোগকারীর দাবি ছিল, তরুন সমাজকে বিপন্ন আর বিপথে চালিত করতে পারে এ উপন্যাস। উপন্যাসটি আদ্যোপান্ত পড়ে, হাস্যকর মনে হয়েছে সেই অভিযোগ! সাহিত্যে অশ্লীলতা আর জীবনে বাস্তবতা এ দুটি বিষয় অনুধাবনে পাঠককে অনেক দায়িত্বশীল হতে হয়। সত্য অনেক সময়ই নির্মম হয়; তা বলে.. মানব না? ছি ছি আর থু থুক্কারে অস্বীকার করে যাব! যে বয়সের পাঠক এই বইটি পড়ার আগ্রহবোধ করবে, তাঁকে কিছুটা মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে তবেই পড়তে হবে। কারণ, গতানুগতিক রক্ষণশীল সমাজমানস নয়; বরং এর সঠিক তাৎপর্য অনুধাবনে চাই তথাকথিত সমাজ নিরপেক্ষ প্রগতিশীল মন। আশা করি, যাপিত জীবনে অতি প্রচলিত দুএকটা কিংবা হোক না তা চল্লিশ-পঞ্চাশেক আপত্তিকর কথা; তা জীবনবাদী সাহিত্য পাঠে অভস্ত্য পাঠকদের শরীরে অথবা মনে এই বয়সে এসে সস্তা সুড়সুড়ি উদ্দীপক কোন অনুভূতির উদ্রেক করবে না। যাহোক, আমার বলার অনেক কিছুই আছে; ছিল। কিন্তু অন্ধের হাতি দর্শনের অভিজ্ঞতা নিশ্চয়ই আমার বন্ধুরা ভুলে যাননি! আর তাই অনেক কথা অনুক্ত রেখেই বলব -- ঝালের মজা যদি বুঝতেই হয়, তবে অন্যের জিভে না চেখে.. নিজের জিভেই চাখুন। উহা কত প্রকার ও কি কি, হাতেনাতে প্রমাণ পেয়ে যাবেন। আমি যতটুকু বললাম, তার অনেকটা জুড়েই যেন.. সুখেন আর শিখার প্রেম! অথচ, উপন্যাসটি মোটেও গতানুগতিক কোন প্রেমের কাহিনীনির্ভর উপন্যাস নয়; সুন্দর কোন কিছুর উপর সহজ একটা দাগের মত এর মূল থিমটাও কেমন যেন স্বাভাবিক। আরও স্বাভাবিক নায়ক সুখেনের মুখের অশ্লীলতা দোষেদুষ্ট স্ল্যাং ভাষাও। শুলাদা নামক অপ্রধান চরিত্রটাও কেমন যেন একটা দ্যুতিময় আশ্চর্য আভার সৃষ্টি করে! শিখা ঠিক রক্ত মাংসের একজন হয়েও যেন.. আর পাঁচটা মেয়ের মত নয়; কি যেন কি রহস্য আছে ওতে। প্রজাপতির প্রসঙ্গ বারবার এসেছে; বিষয়ের সাথে সামঞ্জস্যজনিত কারণেই। শুঁয়োপোকা থেকে প্রজাপতিতে রুপান্তরিত হবার মত একটা আকাঙ্খা, একটা চেষ্টা আর সুখেনের হাতে আহত সেই প্রজাপতির নিস্ফল আস্ফালনের সাথে বোমায় আহত সুখেনের বোধের সাথে সাদৃশ্য যেন তা-ই মনে করিয়ে দেয়। এলোমেলো ভঙ্গিতে ধান ভানতে শিবের গীত গাওয়ার একটাই কারণ, পারেন তো.. বইটা পড়া থেকে বিরত থাকবেন না। ভাল লাগার গ্যারান্টি দিতে না পারলেও.. মন্দ না লাগার শত ভাগ গ্যারান্টি দেয়া বোধহয় কোকিল পুড়িয়ে গলা সুকন্ঠি করার মত অবিশ্বাস্য কিংবা দুঃসাহসী কিছু নয়! 


(১৯/০৫/২০১১)

0 comments:

Post a Comment