যুদ্ধশিশু : জাতি আজ বিবেকের কাঠগড়ায়
প্রবাদটির সত্যতা কতটুকু তা আমি জানি না, তবে নিজেকে দিয়ে কিঞ্চিত বুঝতে পারি বৈকি! কারণ, আজকের এই ভাবনাটা আমার অনেক দিনের। কিন্তু, লিখতে গিয়ে মনে হচ্ছে বড় বেশি সময় নিয়ে ফেলেছি। অতএব, বুঝাই যাচ্ছে আমার জীবনে এ প্রবাদ বাক্যের সত্যতা কতখানি! আমি তো একজন নগণ্য মানুষ মাত্র, যার চিৎকার করা ছাড়া আর কিছুই হয়তো বা করার নেই। কিন্তু আমাদের তথাকথিত বুদ্ধিজীবীরা কেন এতদিন চুপ করে ছিলেন তা আজও আমার ঠিক বোধগম্য নয়। জানি, “বিচারের বাণী নিভৃতে কাঁদে।” কিন্তু তাই বলে যে বিচার প্রায় ৩৬/৩৭ বছর আগে হ ওয়ার কথা ছিল, তা এতদিনেও হয়নি কেন? কিসের স্বার্থে? কাদের স্বার্থে? স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্নগুলো এসে যায়। বলার অপেক্ষা রাখে না আমি কাদের বিচারের কথা বলছি। আশার কথা, এতদিনেও যা হবার কথা হয়নি কিংবা হচ্ছি, হবে করে করেও হয়নি আজ তা হতে চলেছে এবং শুধু মুখে আর কাগজে-কলমে নয়, রীতিমত বাস্তব প্রয়োগ ঘটতে যাচ্ছে। সময় এসেছে আঘাত ফিরিয়ে দেওয়ার, এত বছর আগের পাপ পাপীকে এক এক করে মনে করিয়ে দিয়ে, পাই পাই করে তার প্রতিটি হসাব বুঝিয়ে দেওয়ার। বহু বছরের পুরনো পাপের বিচার যখন একবার বাস্তবায়িত হতে চলেছে, তখন পাপীদের ঘাড়ে পুরনো পাপের ভূত চেপে বসবে এটাই স্বাভাবিক। বিচার প্রক্রিয়া বানচাল করার প্রাণপণ চেষ্টা যে তারা করবে এটাও স্বাভাবিক। তবে বাবাজীদের ঞ্জাতার্থে বলে রাখা ভাল -- বাঙালি যখন একবার জেগেছে, তখন কার ঘাড়ে ক’টা মাথা যে তাদের দাবিয়ে রাখে? আর তাই বাবাজীরা মার মুখো না হয়ে যদি কূটকৌশল অবলম্বন করে লেজ কাটা শেয়ালের মত নতুন নতুন গল্প ফেঁদেও বসে, তবুও খাবারের লোভে কাঁটা বনের ঝোঁপে ঢুকে পড়া কুকুরের মত পালাবার পথ খুঁজে পাবে না। আর তাই ভূতের মত যারা মীরজাফরের সময় থেকে (তার যোগ্য উত্তরসূরী হিসেবে!) বাঙ্গালির ঘাড়ে চেপে বসে, শোষকের পা চেটে চেটে কলাটা-মূলোটা পেয়ে অভ্যস্ত হয়ে বিশাল বপু গড়ে তুলেছে, তাদের বলছি -- হুশিয়ার, সাবধান! বাঙ্গালিকে ঘাঁটাবার সাহস অতিতে দেখিয়েছ, কিন্তু এবার বিন্দুমাত্র চেষ্টাও কোর না। বাঙ্গালির চোখে-মুখে-বুকে যে আগুন জ্বলছে, তাতে জ্বলে-পুড়ে ছাই হয়ে যাবে। গোড়স্থানে গোঁড় দেবার, শ্মশ্মানে পোড়াবার সময়টুকুও হয়তো আত্মীয়-স্বজনের হবে না। নিশ্চিত জেনো -- তোমাদের পাপিষ্ঠ দেহের ছাই বাংলার আকাশে-বাতাসেও উড়বে না। তবে, হাবিয়ায় নিশ্চিন্ত ঠাঁই মিললেও মিলতে পারে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রাসঙ্গিকতায় আরও একটি বিষয় এসে যায় যা না বল লেই নয়, আর তা হল যুদ্ধ শিশুদের কথা (আমি যাদের বলছি যুদ্ধ যীশু)। আমরা জানি, যীশুর কোন পাপ ছিল না। কিন্তু তবুও তাঁকে পাপীদের হাতে ক্রুশবিদ্ধ হতে হয়েছিল। সব শিশুরাই যীশুর মত নিষ্পাপ। তবু কখনও কখনও জন্মকেও প্রশ্নবিদ্ধ হতে হয়। এক একটি শিশুর জন্ম মানে তার পরিবার-পরিজনদের জন্য অনাবিল আনন্দ উতসব। কিন্তু একটা শিশুর জন্মটাই যদি এমন হয় যে তাকে স্বাগত জানানোর কোন আগ্রহই তার পরিবার-পরিজন কিংবা এ সমাজ-সংসারের নেই, তখন? যদি এমন হয় -- মায়ের গর্ভে তার আকস্মিক ঘোষণা এক অজানা আশঙ্ঙ্কায় শঙ্কিত করে তোলে তার গোটা পরিবারকে, তখন? এ ঘটনাগুলোই ঘটেছিল একাত্তরের যুদ্ধ শিশুদের বেলায়, আজ থেকে ৩৭ বছর আগে। চিন্তাও করা যাবে না সেদিনের সেই দৃশ্যপটগুলো। একজন নবীন কিশোরী মায়ের জন্য তা ছিল কতটা দুর্বিষহ, তা একমাত্র সর্বাংসহা পৃথিবীই জানে। ভাবা যায়, সমাজের ভয়ে ফ্যাকাশে হয়ে আসছে নবীন মায়ের মুখ। হয়তো স্কুলের পাঠ তখন শেষি হয়নি। জীবনের পরতে পরতে যে বিভতষতা তার সাথে কখনও পরিচয় ঘটেনি যাদের, সেই কিশোরী মুখগুলোকে ঠেলে দেওয়া হয়েছিল কী কঠিন বাস্তবতার সম্মুখে! যেখানে প্রতিনিয়তই আগুনের আঁচ বুকে লেগে পুড়ে যায় সকল মানবিকতাবোধ, সম্মুখীন হতে হয় নিষ্ঠুরতার-নির্মমতার। আজ থেকে ৩৭ বছর আগে বহু কিশোরী মাকে উপনীত হতে হয়েছিল অসম যুদ্ধে। সন্তানের এক ফোঁটা সুখের আশায় নিংড়ে দিতে হয়েছিল জীবনকে, পাই পাই করে বুঝিয়ে দিতে হয়েছিল সমাজে বেড়ে ওঠার মূল্য। একাত্তরে যুদ্ধ শিশুদের কেউ চায়নি। তাদের পরিবার চায়নি, এ পৃথিবী চায়নি, এ সমাজ চায়নি, কেউ চায়নি, কেউ না। কারণ, সত্যকে যে মানুষের বড় ভয়। তবুও তারা এসেছে। ছোট্ট জীবন বিন্দু মাত্র, অথচ পরিবার-সমাজ-সংসার সবার উপেক্ষার মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছিল এ সম্ভাবনার। কেউ চায়নি তারা আসুক, তবুও তারা এসেছে শত বছরের সংস্কারের শৃঙ্খল ভাংতে, বিদ্রোহ ঘোষণা করতে। কতটা নিষ্ঠুর হলে, কতটা বর্বর হলে একটা মানুষ কৃতঘ্ন হয়ে উঠতে পারে তার একটা বড় পরিচয় আমাদের এই সমাজ। যাদের জীবনের বিনিময়ে, যাদের রক্তের বিনিময়ে, যাদের ইজ্জতের বিনিময়ে, যে সকল ভ্রুনেই নষ্ট করে ফেলা জীবনের বিনিময়ে আমরা পেলাম আমাদের লাল-সবুজ পতাকা, মানচিত্র, ভাষা, স্বকীয় জাতিসত্তা -- সামগ্রিকভাবে চির আকাঙ্খিত স্বাধীনতা, সেই অগণিত নিবেদিত প্রাণ শহীদ, বীরাঙ্গনা, মুক্তিযোদ্ধা আর যুদ্ধ শিশুদের প্রতি আমাদের আজকের কৃতজ্ঞতা সত্যিই কৃতঘ্ন জাতির স্মারক বহন করে বৈকি! একজন নারীর জন্য ট্রয় নগরী যুদ্ধের আগুনে পুড়ে খাক হয়ে গিয়েছিল, সে কথা আমরা সবাই জানি। কিন্তু এই বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য যে হাজার হাজার নারীর সম্ভ্রম হায়েনাদের লালসার আগুনে পুড়ে খাক হয়ে গিয়েছিল তার পরিসংখ্যান কি বাঙালি রেখেছে? রাখেনি। আমি শুনেছি, আজও অনেক মায়ের চোখের দৃষ্টি অসীমের পাণে কি যেন খুঁজে বেড়ায়। তাঁদের ভারাক্রান্ত হৃদয়ে অসীম এক শূন্যতা। কি খুঁজে বেড়ায়? তার হারানো শিশুকে। কিসের শূন্যতা? সন্তান হারানোর শূন্যতা। একজন মায়ের কাছ থেকে সন্তানকে আলাদা করে ফেলা যে কত বড় পাপ তা যদি এ সমাজ জানতো, তবে একাত্তরে এ ভুল তারা কখনই হয়তো করতো না। ৩৭ বছর আগে খোদার আরশ কেঁপে উঠেছিল এ সমাজের বর্বরতা দেখে। আর তাই তো আজও সেই পাপের ফল ভোগ করছে এই সমাজ। আমার লেখাটিকে যদি কেউ যুক্তি-তর্কের নিরিখে বিচার করতে বসে, তবে এই লেখার সত্যে সে বাঁধা পড়বে না। কারণ, আমি প্রবন্ধ লিখতে বসিনি, বসেছি এক জাতির হারানো সম্পদ আর তা আজও খুঁজে না পাওয়ার ব্যর্থতার ফিরিস্তি লিখতে। তাই পাঠক সমাজের কাছে আমার আর্জি থাকবে -- তারা যেন আবেগ তাড়িত হয়ে এ কলাম পড়েন, যুক্তির নিরিখে নয়। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না আমরা সত্যের বাঁধনে বাঁধা। সব সত্যকে যুক্তি দিয়ে বিচার করা যায় না, এ জন্য চাই হৃদয়ের গভিরতা, বাঁধভাঙ্গা আবেগের জোয়ার। কারও কারও জন্মটাই ব্যথার, জীবন-যাপনটাও ব্যথার। আর এভাবেই এক সময় ব্যথাটাই অনেকের জীবনে চোখের মতই অপরিহার্য হয়ে ওঠে। ঠিক তেমনি আমাদের এই স্বাধীন দেশের জন্মটাও ব্যথার, জীবন-যাপনটাও ব্যথার। আর সেই ব্যথাটাই আজ অপরিহার্য হয়ে উঠেছে আমাদের জীবনে।
(বি.দ্র. : সরকারকে মনে রাখতে হবে যে, এনালগ সত্য ও স্বপ্নগুলোকে বাদ দিয়ে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়া সম্ভব নয়। আর
তাই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া যেমন শুরু হতে চলেছে, তেমনি সময় এসেছে যুদ্ধ শিশুদের বিষয়টিও গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করার।)
( এই লেখাটি ২০০৯ সালের ১৬ই জুলাই “দৈনিক জনকন্ঠ”
পত্রিকার ‘চতুরঙ্গ’ পাতায় প্রকাশিত হয়েছিল।)
0 comments:
Post a Comment